ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরবি ছিল শুধু আরব উপদ্বীপের ভাষা। তখন তা ছিল শত শত উপভাষায় বিভক্ত। এর মধ্যে কুরাইশ বংশের ভাষা ছিল আরবের বিশুদ্ধতম ভাষা। এটিই ছিল তৎকালীন আরবি সাহিত্যের ভাষা।
এ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের চিরবিস্ময় মানবজাতির হেদায়াতের গ্রন্থ পবিত্র কোরআন। আল্লাহ বলেন, ‘এভাবে আমি আপনার ওপর আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছি যেন আপনি মক্কা ও এর চতুর্দিকের অধিবাসীদের সতর্ক করতে পারেন…। ’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৭)
অর্ধশতাব্দীর কম সময়ে আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় পৌঁছে যায় ইসলামের সুমহান বার্তা। পাশাপাশি এসব অঞ্চলে কোরআন ও আরবি ভাষাও ছড়িয়ে পড়ে। বিজিত জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ইসলাম এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় আরবিকে আপন করে নেয়। ইসলামের প্রতি ভালোবাসা থেকে আরবি ভাষাকে তারা গ্রহণ করে। কারণ ইসলাম ও আরবি ভাষা একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইসলামের অনুসারী মাত্রই আরবি ভাষা শিখতে ও জানতে বাধ্য। ওমর (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা আরবি ভাষা ভালোভাবে শেখ। কারণ তা জ্ঞানকে সুদৃঢ় করবে এবং ব্যক্তিত্ববোধ বৃদ্ধি করে। ’ (বাইহাকি, হাদিস : ১৫৫৬)
আজকের ইরাক, সিরিয়া, মিসর, জর্দান, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কোসহ অনেক দেশের মাতৃভাষা আরবি। এ ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশ, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইয়ের মতো মুসলিম দেশগুলোর কোটি কোটি মুসলিমের দ্বিতীয় ভাষা হয়ে ওঠে আরবি। ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার অনেক দেশ আরবিকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ না করলেও আরবি বর্ণমালাকে গ্রহণ করে নিজেদের মাতৃভাষার জন্য। অল্প সময়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা হয়ে ওঠার ইতিহাস আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষার নেই। পাশাপাশি মাতৃভাষা না হলেও মুসলিম দেশগুলোতে আরবি শব্দ ও বাক্যের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। দোয়া, ইবাদত ও আমল—সব দেশে আরবিতেই হয়।
পৃথিবীর অনেক ভাষাই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আবার এমনও ভাষা আছে, যার প্রাচীন রূপের সঙ্গে আধুনিক রূপের পার্থক্য যোজন যোজন। কিন্তু আরবি ভাষার লেখ্য ও বিশুদ্ধ রূপটি এখনো অবিকৃত ও অপরিবর্তিত, ঠিক প্রাচীন আরবির মতোই। এটি আরবি ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য। এর অন্তর্নিহিত কারণ হলো তা পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষা। পৃথিবীতে যত দিন মানবজাতির অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন কোরআন ও হাদিস থাকবে। আর এই দুটি বিদ্যমান থাকার মানেই হলো আরবি ভাষার অস্তিত্ব থাকা। আরবি ভাষার সঙ্গে যে জাতির সম্পর্ক যত গভীর, ইসলামের সম্পর্কও তাদের সঙ্গে তত নিবিড়।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা ইংরেজির কথাই ধরা যাক। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়ারের (১৫৬৫-১৬১৬) ইংরেজির সঙ্গে বর্তমান ইংরেজির পার্থক্যটা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবে। মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগিরের প্রণয়োপাখ্যান ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কিংবা আরাকান রাজসভার কবি আলাউলের শ্রেষ্ঠ কাব্য হিসেবে পরিচিত ‘পদ্মাবতী’র বাংলা আর কবি নজরুল ও ফররুখের বাংলা যে এক নয়, তা বাংলা ভাষার পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে আরবি পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যার বর্তমান রূপের সঙ্গে ষষ্ঠ শতাব্দীর কবিসম্রাট ইমরুল কায়েস বা রাসুলের কবি খ্যাত হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর কবিতার ভাষা এবং আধুনিক যুগের কবিসম্রাট আহমদ শাওকির কবিতার ভাষার কোনো তারতম্য নেই।
আরবি ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারলেই মুসলিম উম্মাহকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ হয়ে যায়। এ নিগূঢ় রহস্য উপলব্ধি করেই সাম্রাজ্যবাদীরা যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের জাল বিস্তৃত করেছে, সেখানেই আরবি ভাষার সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে স্পেন হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে একই দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
বর্তমানে আরববিশ্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অন্যতম টার্গেট। কারণ এখানেই ইসলামের সূতিকাগার। আরবদের হাত ধরেই একসময় বিশ্বময় সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম ও আরবি ভাষা। আরবদের তাদের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। তাই আরব তরুণদের হাত ধরেই গড়ে উঠছে একটি নতুন আরবসমাজ, যেখানে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি যেখানে অপাঙক্তেয়, যার প্রভাব জীবনাচার ও ধর্ম-কর্মে লক্ষণীয়। আধুনিক যুগের কবিসম্রাট মিসরীয় কবি আহমদ শাওকি (১৮৬৮-১৯৩২) আরবি ভাষার প্রতি আরবদের অবহেলার করুণ চিত্র তুলে ধরেন। রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আল লুগাতুল আরবিয়্যাহ তানআ হায্যাহা বায়না আহলিহা’ (‘স্বজাতির কাছে অবহেলার শিকার আরবি ভাষার শোকগাথা’)। শত বছরের অবহেলা দানা বাঁধতে বাঁধতে এখন ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে তাদের ফিরে আসতে হবে ইসলামের কাছে এবং আরবি ভাষার কাছে। নতুবা একদিন তারা তাদের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামকেও হারাবে। কারণ ইসলামই আরবি ভাষাকে অমর করেছে। ইসলামই আরবি ভাষাকে মহান করেছে। ইসলামই আরবি ভাষার রক্ষাকবচ।
আল্লামা সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদভি (রহ.) বলেন, ‘বিশ্বময় আরবি ভাষার প্রচার-প্রসার ও শক্ত অবস্থান তৈরির বিষয়টি অন্যান্য ভাষা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। যুগে যুগে মুসলিমবিশ্বের শাসনক্ষমতায় যারাই ছিল, সব সময় আরবি ভাষা ছিল রচনা, গবেষণা, সাহিত্য, ইতিহাস, ফিকহ, হাদিস, তাফসির ও দর্শনচর্চার ভাষা। ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে আছে অসংখ্য আরবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব অঞ্চলে রয়েছেন অসংখ্য বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব, যাঁরা মাতৃভাষার মতো আরবি ভাষায় পারদর্শী। এর মূল কারণ হলো, আরবি পবিত্র কোরআনের ভাষা, ইসলাম ও ইসলামী শরিয়তের ভাষা। ’ (ইসমাউ মিন্নি সারিহাতান আইউহাল আরব, পৃষ্ঠা : ২০)